অনলাইন ডেস্ক ::
প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আগামী সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবর মাসে সুবিধাজনক সময়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য সৌদি আরব যাচ্ছেন খালেদা জিয়া। সরকারের উচ্চপর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিষয়ে সরকার শুরু থেকে আন্তরিক থাকলেও; রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাব করে বিলম্ব করেছে বিএনপি। নিজেদের ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক সক্ষমতার ওপর আর ভরসা না রেখে দলীয় প্রধানের উন্নত চিকিৎসার জন্য প্যারোলের আবেদন করতে পারে দলটি।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র এমন সম্ভাবনার কথা সময়ের আলোকে জানিয়েছেন। রাজনৈতিক এ সমঝোতার অংশ হিসেবে বিএনপিও এখন অনেকটা নমনীয়। খালেদা জিয়া এর আগেও সৌদি আরবের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। সব ঠিক থাকলে সেখানে এবারও তিনি চিকিৎসা নিতে যেতে পারেন। খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বিএনপি নেত্রীর প্যারোলের বিষয়ে এর আগে বাঁধা ছিল লন্ডনে অবস্থানরত তার বড় ছেলে তারেক রহমান। সম্ভবত এবার তাদের দলের সবাই প্যারোলের পক্ষে।
এ সমঝোতার নিদর্শন হিসেবে একটি পরিস্থিতিকে চিহ্নিত করে সরকারের একজন মন্ত্রী বলেন, এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার লন্ডন সফরে বেশ কয়েকবার প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন। এর পেছনে ছিল লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এ জন্য প্রতিবারই একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির জন্ম হতো। কিন্তু এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লম্বা সফরে লন্ডন অবস্থান করছেন। সেখানে ইউরোপের রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে সম্মেলন করেছেন। দেশের কয়েকটি অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়েছেন। তিনি সেখানে চোখের চিকিৎসা করাচ্ছেন। মায়ের প্যারোলের জন্যই এবার আর তারেক রহমান ‘ভুল’ পথে যাননি।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অবস্থান করছেন। তার নির্দেশেই সেখানকার প্রবাসী বিএনপি নেতাকর্মীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমনে এর আগে বেশ কয়েকবার প্রতিবাদ করেছেন। কালো পতাকা দেখিয়েছেন। কিন্তু এবার সেখানে কোনো প্রতিবাদ হয়নি। ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতাও বলছেন, খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি ও চিকিৎসার জন্যই সমঝোতার অংশ হিসেবে বিএনপি এবার বেশ নমনীয়।
চলতি বছরের মার্চ থেকেই দেশের রাজনীতিতে শোনা যাচ্ছে, উন্নত চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি নিয়ে কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিদেশ যাবেন। চলতি বছরের শুরু থেকেই বিএনপি খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে আসছিল। সরকারও রাজি ছিল। কিন্তু বাঁধ সাধে বিএনপির ঢাকা আর লন্ডনের দ্বিমুখী সিদ্ধান্ত। বিএনপির রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাব। বিষয়টি খালেদা জিয়া নিজেও জানেন। বেশ কিছু দেশের ক‚টনীতিকরাও খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিষয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে।
এসব কূটনীতিকদের পরামর্শ অনুযায়ীই বিএনপি সংসদে ফিরেছে এবং গঠনমূলক রাজনীতির অংশ হিসেবে বিএনপি মহাসচিব বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ করছেন। সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে কোথাও কোনো বাধা দেওয়া হয়নি।
সূত্র বলছে, সমঝোতা প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ে আনা হয়েছে। মেডিকেল বোর্ডে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক তথা খালেদা জিয়ার ভাগ্নে ডা. মামুনকেও রাখা হয়েছে। এখান থেকেই আইনী প্রক্রিয়া সেরে মেডিকেল বোর্ডের সার্টিফিকেট ও স্থানান্তরের সুপারিশ নিয়েই খালেদা জিয়াকে সৌদি আরব পাঠানো হতে পারে।
বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য দাবি করে এলেও কারাবিধি অনুযায়ী তাকে সরকারি হাসপাতাল বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় হাসপাতালের কেবিনে ভর্তি করা হয়। খালেদা জিয়ার দাঁত ও জিহŸার চিকিৎসা বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে ভালোভাবে সম্পন্ন হলেও তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ডায়াবেটিস খুব ঊর্ধ্বমুখী। এর প্রভাবে তিনি যেকোনো সময় আরও বেশি অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন। এ বিষয়টি আমলে নিয়েই বিএনপি খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির দিকে আগাচ্ছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিএনপির সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়ার সময় থেকেই এ বিষয়টি সামনে চলে আসে। খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরাও চান প্যারোলে মুক্তি। তাদের ধারণা, আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তি আরও বিলম্ব হতে পারে। আর ভঙ্গুর সাংগঠনিক অবস্থা নিয়ে রাজপথের কঠোর কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে চাপে ফেলে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা কঠিন। সরকার পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে আইনী প্রক্রিয়াতেই খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে। আন্দোলন করে মুক্ত করা যাবে না।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে সরকার প্রথম থেকেই ইতিবাচক। এর আগে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বিএনপি চাইলে বিদেশে চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, বিএনপি প্যারোলে মুক্তির আবেদন করলে সরকার বিবেচনা করবে।
তখন বিএনপি সিদ্ধান্তহীনতায় ছিল। এখন তারা আবারও বিষয়টি ভাবছে। এ জন্য দলটি কোনো ধ্বংসাত্মক ও হিংসাত্মক কর্মসূচিতে যাচ্ছে না। এ বিষয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না- প্যারোলে মুক্তি নিলে তাদের রাজনৈতিক লাভ-লোকসান কতটুকু। আওয়ামী লীগ বারবার বলে আসছে, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে বিএনপি তার চিকিৎসা নিশ্চিতের চেয়ে রাজনীতিই বেশি করছে।
জেলকোড অনুযায়ী প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত। সরকার ইচ্ছা করলে কাউকে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্যারোলে মুক্তি দিতে পারে। এর আগে সেনাসমর্থিত সরকারের সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমে সময় একটা বেঁধে দেওয়া হয়। পরে প্রয়োজনে তা বৃদ্ধি করা যায়।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি নিয়ে চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ আলোচনা উঠেছিল। ওই সময় বিএনপির পক্ষ থেকে তা প্রত্যাখ্যান করে বলা হয়েছিল, তারা খালেদা জিয়ার প্যারোল চায় না; দলীয় প্রধানের নিঃশর্ত মুক্তি চায়। দুই মাস পর আবার দলটি মত পরিবর্তন করছে।
শুক্রবার বিকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের প্রতি আহŸান জানিয়ে বলেন, অবিলম্বে সরকারের কাছে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি জানাচ্ছি। তার পছন্দ অনুযায়ী দেশে অথবা বিদেশে যেখানে তিনি চিকিৎসা করাতে চান, সেখানেই তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, আন্দোলন করে বিএনপির পক্ষে সরকারের ওপর ন্যূনতম রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা এই মুহূর্তে অসম্ভব। এটি বিএনপিও জানে। তাই তারা এখন তাদের দলীয় প্রধানের মুক্তি চাইলে; প্যারোলে আবেদন করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নাই। আর সরকার অনেক দিন আগে থেকেই বিএনপির প্যারোল আবেদনের অপেক্ষা করছে।
পাঠকের মতামত: